সুলতান মনসুরের এমপি পদ কি টিকবে?

নিজস্ব প্রতিবেধক
  • প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯
  • ৬৪১ দেখেছেন

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর সংসদ সচিবালয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে শপথ নেন তিনি।

এদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সুলতান মনসুর শপথ নেয়ার তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম।দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে গণফোরামের সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সুলতান মনসুরকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানান গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দলীয় শৃংখলা বিরোধী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আদর্শবিরোধী কাজ করায় সুলতান মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হল। সেই সঙ্গে তার দলীয় প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হল।

মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে।তিনি ভোটে জয়ীও হন।তখন আমরা তাকে স্বাগতও জানিয়েছিলাম।

তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের তামাশার নির্বাচনে ফল প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় ঐক্যফ্রণ্ট ও গণফোরাম। সেই সিদ্ধান্তের কথা সুলতান মনসুরকে জানানোও হয়।জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি শপথ না নিলেও সুলতান মনসুর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আজ সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন।তাই গণফোরাম তাকে দল থেকে বহিষ্কার করছে।তার প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করা হলো।

গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক জানান, সুলতান মনসুরের বহিষ্কারের চিঠি স্পিকার বরাবর পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গণফোরাম বহিষ্কার করায় সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্য পদ কি টিকবে? এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।

সুলতান মনসুর শপথ নিলেও সংসদ সদস্য হিসেবে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে পরস্পর বিরোধী মত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দুই কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হতে পারে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য যদি তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন (ফ্লোর ক্রসিং) অথবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে যদি শপথ না করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলে তার সংসদ সদস্যপদ যাবে না। তবে এ ব্যাপারে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ নেই।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে কেউ শপথ না নিলে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। তাছাড়া সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিলেও তার সদস্যপদ থাকবে না।

এক প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, কোনো সংসদ সদস্য যদি তার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নেন এবং দল যদি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি আটকে যাবেন। অর্থাৎ তাদের সদস্যপদ থাকবে না। সেক্ষেত্রে গণফোরামের নির্বাচিত দুইজন শপথ নিলেও দল না চাইলে তাদের সদস্যপদ থাকবে না।

সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য নির্বাচনের পর এমপি পদে থাকার অযোগ্য হবেন কি না, কিংবা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সাংসদের আসন শূন্য হবে কি না—এ সম্পর্কিত কোনো বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের নিকট পাঠানো হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, সুলতান মনসুর দল থেকে পদত্যাগ করেননি। সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার বিষয়টি তো আরও পরের কথা। তবে তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নিলে এবং ওই অবস্থায় দল তাঁকে বহিষ্কার করলে পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।এই যুক্তিতে সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্যপদ টিকে যেতে পারে।

অতীতেও এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে।নবম সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তাঁর সদস্যপদ স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে বহাল ছিল।

এর আগে অষ্টম সংসদের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। সে ক্ষেত্রেও তাঁর সদস্যপদ বহাল ছিল। দুটি ক্ষেত্রেই সংসদের ব্যাখ্যা ছিল, দল তাঁদের বহিষ্কার করেছে কিন্তু তাঁরা দল থেকে পদত্যাগ করেননি। যে কারণে তাঁদের সদস্যপদ বহাল ছিল।

দশম সংসদে সরকারদলীয় সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দল থেকে পদত্যাগ করেন। এ কারণে তিনি সংসদ সদস্যপদ হারান।

এমতাবস্থায় গণফোরাম সুলতান মনসুরকে বহিষ্কারের পর স্পিকারকে চিঠি দিলে স্পিকার বিতর্কটি নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।

প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে নাম লিখিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে ভোট করে জয়ী হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। আর দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন প্রবাসী মোকাব্বির খান গণফোরামের দলীয় প্রতীক ‘উদীয়মান সূর্য’ নিয়ে সিলেট-২ আসন থেকে জয়ী হন। ওই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী না থাকায় বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও গণফোরাম একাদশ নির্বাচনের ফল বর্জন করে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত অপর পাঁচ সদস্য শপথ না নিলেও একাদশ সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির। পরে অবশ্য শেষ মুহূর্তে ভোল পাল্টান মোকাব্বির। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শপথগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন তিনি।

মোকাব্বির শপথ না নিলেও শপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন সুলতান মনসুর। আজ তিনি শপথ নিয়েই নিলেন।

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর শপথ নিলেই তার বিরুদ্ধে দলীয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল গণফোরাম। দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি স্পিকারকেও অবহিত করা হবে।

বুধবার বিকালে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে বৈঠক করেন গণফোরামের শীর্ষ নেতারা। এই বৈঠকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কেউ শপথ নিলে তার বিরুদ্ধে দলীয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে বিষয়টি স্পিকারকে লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। দলের এই সিদ্ধান্তের পরপরই সুর বদলান মোকাব্বির খান। আপাতত শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

তবে দলীয় সিদ্ধান্ত তোয়াক্কা না করে শপথ নিলেন সুলতান মনসুর। তিনি আগেই বলেছিলেন, ড. কামাল না চাইলেও তিনি শপথ নেবেন।আর গণফোরাম বলে আসছিল, দলের ব্যানারে ভোট করে নির্বাচিত সুলতান মনসুর কিছুতেই দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করতে পারেন না।

এ বিষয়ে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বুধবার যুগান্তরকে বলেছিলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কেউ শপথ নিলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। দলীয় সিদ্ধান্ত এবং আইনগত সিদ্ধান্ত যা নেয়া দরকার, সেগুলো আমরা নেব।

এ বিষয়ে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীও আগেই বলেছিলেন, বর্তমান সংসদে ঐক্যফ্রন্টের কোনো সংসদ সদস্য শপথ নেবে না এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।এর বাইরে যে যাবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আজ সেই সাংগঠনিক ব্যবস্থাই নেয়া হল। বহিষ্কার করা হল সাবেক ডাকসু ভিপিকে।

শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী কর অব্যাহতি-প্রণোদনা কমিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই ধারাবাহিকতায় এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে বৈষম্য কমিয়ে আনতে সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়া ও অন্য ভাতায় করারোপের চিন্তা করছে সংস্থাটি। এছাড়া শিল্প খাতে কর অবকাশ সুবিধার মেয়াদ নির্দিষ্ট করাসহ আয়কর আইন সংস্কারে একগুচ্ছ পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা আগামী বাজেটে অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

জানা গেছে, কর অব্যাহতি-প্রণোদনা যৌক্তিক করতে কর আপিল ও অব্যাহতি অণুবিভাগের সদস্য ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল কাজ করছে। ২০ মার্চ সেই টিম এনবিআর চেয়ারম্যানকে কর প্রণোদনার প্রেক্ষাপট, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিস্তারিত তুলে ধরে একটি উপস্থাপনা দেয়।

উপস্থাপনায় কর অব্যাহতি-প্রণোদনার বিদ্যমান ব্যবস্থা ও পদ্ধতি, নেতিবাচক দিক, প্রয়োজনীয়তা, অপব্যবহার, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে আয়কর আইন সংস্কারের মাধ্যমে কর প্রণোদনা যৌক্তিকীকরণে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়।

উপস্থাপনায় বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, দেশীয় বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, রপ্তানিমুখী সেবা ও শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সহযোগিতা দেওয়া, গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমকে উৎসাহ দেওয়া এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শ্রমঘন প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে কর প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। মোট ৩১৮টি প্রজ্ঞাপন ও বিশেষ আদেশের মাধ্যমে ১৫টি শিল্প খাত ও ব্যক্তি খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। এর মধ্যে ৪৫টি প্রজ্ঞাপন সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ হলেও প্রায় ২৭৩টি প্রজ্ঞাপনের সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তবে কর প্রণোদনার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। ফলে সরকার অন্য প্রয়োজনীয় খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে পারে না।

এতে আরও বলা হয়, কর প্রণোদনার অপব্যবহারও হয়ে থাকে। কর ফাঁকি দিতে একই ব্যক্তি বা গ্রুপর করযোগ্য সত্তার আয় কম দেখিয়ে কর প্রণোদনার সত্তার আয় বাড়িয়ে দেখানো হয়ে থাকে। কর প্রণোদনা পরিপালন ব্যয় বৃদ্ধি করে, দুর্নীতি ও অনিয়ম বেড়ে যায়। অপরিকল্পিত কর প্রণোদনার ক্ষেত্রে প্রকৃত কর ব্যয় এবং কর ব্যয়ের সফলতা বা সুবিধা সুনির্দিষ্টভাবে পরিমাপযোগ্য হয় না। তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিত প্রণোদনা ব্যবসার অসম প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কর প্রণোদনা যৌক্তিক করতে এবং অপব্যবহার রোধে আয়কর কর্মকর্তাদের একটি টিম বিদ্যমান কাঠামো পর্যালোচনা করছে। কর প্রণোদনায় শৃঙ্খলা আনতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। ভবিষ্যতে সেই নীতিমালার আলোকে কর অব্যাহতি, প্রণোদনা বা ছাড় দেওয়া হবে। আগামী বাজেটে নীতিমালাটি আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, কর অব্যাহতির পরিমাণ যৌক্তিক করতে এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে বৈষম্য দূর করতে সরকারি চাকরিজীবীদের ভাতায় কর আরোপের পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মূল বেতন, বোনাস, বাড়িভাড়া, যাতায়াত ভাতাসহ মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর (এক-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ৪ লাখ টাকার নিচে যেই অঙ্ক কম, সেই অঙ্কে করছাড় রয়েছে। অর্থাৎ করমুক্ত) নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হয়। পক্ষান্তরে সরকারি চাকরিজীবীরা শুধু মূল বেতন ও বোনাসের ওপর আয়কর দেন।

এছাড়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানিক করদাতারা বিভিন্ন খাতে দানের পরিপ্রেক্ষিতে যেই পরিমাণ করছাড় পেয়ে থাকেন, সেগুলোও পুনর্বিন্যাস করার উদ্যোগ থাকছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং কৃষি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে দান করতে করছাড় পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে করছাড় যৌক্তিক করার পাশাপাশি প্রণোদনার সম্ভাব্য অপব্যবহার রোধে দাতব্য এবং জনকল্যাণমূলক ট্রাস্টের কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, আগামীতে শিল্প খাতকে অনির্দিষ্টকাল বা অসীম সময়ের জন্য কর অব্যাহতি বা প্রণোদনা দেওয়া হবে না। শিল্পকে উৎসাহিত করতে কর প্রণোদনা বহাল থাকবে। তবে সেটি সময়াবদ্ধ হবে, সর্বোচ্চ ৫ বছর করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কর অব্যাহতি বা প্রণোদনা পেয়েছে, সেগুলো নতুন করে সুবিধা দেওয়া হবে না। ব্যবসা ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে, এমন সব প্রণোদনা বাতিল করা হতে পারে।

এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, সেনাবাহিনী বা যেসব প্রতিষ্ঠানের আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু করযোগ্য আয় রয়েছে, তাদের গ্রসপ্রাপ্তির সংবলিত একটি বার্ষিক রিপোর্ট দালিল এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর পরিশোধের বিষয় আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একইভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের করযোগ্য প্রাপ্তির ওপর করারোপের সুস্পষ্ট বিধান করার পরিকল্পনা আছে।

এ বিষয়ে সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আয়কর আইনে বেশকিছু বৈষম্য আছে। এর মধ্যে একটি হলো সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন-ভাতা করমুক্ত রাখা এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর করারোপ করা। একই আইনে চাকরিজীবীদের ওপর দ্বৈতনীতি কাম্য হতে পারে না। সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরা আইন করেছেন বলে নিজেরা সুবিধা নিয়ে নেবেন, আর বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেবেন, সেটি যৌক্তিক হতে পারে না। সব শ্রেণি-পেশার চাকরিজীবীর সমান সুবিধা দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, কর অবকাশ সুবিধা যৌক্তিকীকরণ করা উচিত। কোনো সুবিধাই আজীবনের জন্য দেওয়া উচিত নয়। এতে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না, বরং অপব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেমন আইটিইএস সার্ভিস ১৫ বছর ধরে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে; কিন্তু নতুন অনেক শিল্পোদ্যোগের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া দরকার, তারা সুবিধা পাচ্ছে না। আয়কর আইনে যেসব শিল্পকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া আছে, সেগুলো পুনর্বিন্যাস ও যৌক্তিক করা জরুরি। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের কর ব্যয় আরও স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত।

৫-১৩ মার্চ আইএমএফের ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের ‘কর ব্যয়’ ওপর ওয়ার্কশপে অংশ নেয়। তারা কর অব্যাহতি কমিয়ে আনতে ২০২৪ সাল অর্থ আইনের মাধ্যমে আয়কর আইনে কী পরিবর্তন আনতে হবে, ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পরবর্তী ব্যবসায় সক্ষমতা ধরে রাখতে মধ্য মেয়াদে ২০২৫ সালে এবং দীর্ঘমেয়াদে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে আইনে কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে তার সুপারিশ করেছে। আইএমএফের সুপারিশের মধ্যে আছে-সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন এবং বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সব ধরনের ভাতা করের আওতায় আনা, ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের অব্যাহতি সুবিধা বাতিল (বর্তমানে মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ অথবা সাড়ে ৪ লাখ টাকার মধ্যে যেটি কম সেই অঙ্কের করছাড় পায় করদাতারা), করমুক্ত আয়সীমা ও ন্যূনতম করহার বৃদ্ধি এবং শিল্প খাতে প্রদত্ত কর অব্যাহতি পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

কোন খাতে কত কর ব্যয় : এনবিআরের তথ্যমতে, ক্ষুদ্রঋণ খাতে সবচেয়ে বেশি কর ব্যয় হয়, ১৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এরপরের অবস্থানে আয়ে যথাক্রমে বৈদেশিক আয় খাতে ১১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৮ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে ৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, তৈরি পোশাক/টেক্সটাইল মিল/এক্সেসরিজ শিল্পে ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা, আইটি/সফটওয়্যার খাতে এক হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, শেয়ার মূলধনী মুনাফা ৯৬৫ কোটি টাকা এবং মৎস্য চাষ ও হাস-মুরগির খামারে ১৪৩ কোটি টাকা কর ব্যয় হয়।

প্রত্যক্ষ কর ব্যয় বলতে কর রেয়াত, ছাড়, প্রণোদনা, অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা হতে আয় বাদ দেওয়াকে বোঝায়। এটি এক ধরনের ভর্তুকি। এই ভর্তুকি যদি কর হিসাবে আয়দায় হতো তা হলে মোট আদায়কৃত করের সঙ্গে এটি যুক্ত হতো এবং করের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রণোদনা, সামাজিক সাম্যাবস্থা ও শিল্প সহায়তার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। চলতি বছরের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের একটি ধারণা দেয় এনবিআর, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়।

এনবিআরের হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে করপোরেট পর্যায়ে ৮৫ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ও ব্যক্তিপর্যায়ে ৪০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির আকার বিবেচনায় প্রত্যক্ষ কর ব্যয় হবে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা।

সরকারি কর্মচারীদের ভাতায় করের চিন্তা

LifePharm